ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান প্রথম কে দিয়েছিলেন সে বিষয়ের উপর আজকের আর্টিকেলটি সাজানো হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত স্লোগান 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ছাত্রদের হাত ধরে সড়ক দুর্ঘটনার আন্দোলনে উচ্চারিত হয়।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান প্রথম কে দিয়েছিলেন
এখন মূল বিষয় হলো, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান টি কার, কেন এ স্লোগানটি এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, কোথা থেকে এর উৎপত্তি অর্থাৎ ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটির ইতিহাস সম্পর্কে আজকের আর্টিকেল থেকে জেনে নেব।
ইনকিলাব কোন ভাষার শব্দ
ইনকিলাব আরবি ভাষার শব্দ। ইনকিলাব (আরবি - اِنقلاب ) শব্দের বাংলা অর্থ- বিপ্লব, বিদ্রোহ, আন্দোলন। তবে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বাক্যাংশটি উর্দু ভাষার। যার অর্থ - বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। ইনকিলাব শব্দটি সাহিত্যে প্রথম ব্যবহার করেন মোহাম্মদ ইকবাল।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ ইতিহাস
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটির বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের মধ্যে বিশেষ ভাবে দুটি স্লোগান 'বন্দেমাতরম' এবং 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' উল্লেখযোগ্য।
কংগ্রেসের প্রতিবাদী আন্দোলনের একটি বিশেষ অঙ্গ হয়ে ওঠে 'বন্দেমাতরাম' স্লোগানটি। তবে সে সময় খিলাফত আন্দোলন শুরু হওয়ায় এটিকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ গ্রহণ করেননি। কংগ্রেস খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থ করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর সমর্থনে, মুসলিম সমাজকে জাতীয় আন্দোলনের অংশীদার করার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু বন্দেমাতরম স্লোগানটি নিয়ে আপত্তি শুরু হয়, বিশেষ করে বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে বন্দেমাতরম স্লোগানটি হিন্দু মূর্তি পূজার প্রতিচ্ছবি হিসেবে চিত্রিত হয়। এরপর থেকে এই স্লোগানটি দিয়ে বেশি আপত্তি উঠতে থাকে। বন্দেমাতরম স্লোগানটি কংগ্রেস এখনো ব্যবহার করে আসছে। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জনগণমন' জাতীয় সংগীত হিসেবে কংগ্রেস নেতারা বেছে নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে, ১৯২১ সালে মাওলানা হাসরাত মোহানি আমেদাবাদের কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথম 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগানটি দেন। তিনি ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে স্লোগানটি দেন। তৎকালীন অনেক ভারতীয়দের মধ্যে রুশ বিপ্লবের প্রতি অনুরাগ ছড়িয়ে পড়েছিল তারই পটভূমিতে এই স্লোগানটি উচ্চারিত হয়।
যদিও এ স্লোগানটি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি এবং কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সমর্থনযোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে ১৯২৮ সালে ভগৎ সিং ও তার সহযোদ্ধাদের দ্বারা বেশি ব্যবহৃত হয়।
শুধু 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগানই মাওলানা হাসরাত মোহানি সৃষ্টি করেননি বরং তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লবে।মোহানির পূর্বপুরুষ ছিলেন ইরানের তবুও তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লবের ইতিহাসে তার জীবন এবং কর্মের প্রভাবের কারণে তিনি এখনো স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। মাওলানা হাসরাত মোহানি স্মরণে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় একটি ছাত্রাবাস এবং কানপুরে একটি হাসপাতাল এখনো রয়েছে।
বন্দেমাতরাম এবং ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দুটি ব্রিটিশ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিভিন্ন মতামত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ করেছে, যা আজও জাতীয় আলোচনার অংশ হিসেবে রয়ে গেছে।
১৯২৯ সালে দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভা বোমা হামলার পর ভগৎ সিং ও তার সঙ্গী বটুকেশ্বর দত্ত জনসম্মুখে 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগানটি দেন। দিল্লি হাইকোর্টে ১৯২৯ সালের জুন মাসে প্রথমবারের মতো তাদের বিবৃতির অংশ হিসাবে এই স্লোগানটি ব্যবহার করেন। ফলে, স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভারতীয় জনগণের মধ্যে 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগানটি ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করে।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি ভগৎ সিং এবং তার সহযোগীরা তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রতীকে পরিণত করেন। এই স্লোগানটির মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের মধ্যে ভগৎ সিং এবং তার সহযোগীরা জাগরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি পরবর্তী সময়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। আজও এই স্লোগানটি বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতার উৎসবগুলোতে জনসম্মুখে উচ্চারিত হয়।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়াও হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এবং কমিউনিস্ট একত্রিকরন এর অফিসিয়াল স্লোগানও হিসেবেও ছিল। এছাড়াও অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স এর একটি স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অর্থাৎ স্লোগানটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠে।
বর্তমানে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি শুধু ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও নানা ধরনের বিক্ষোভ, নাগরিক অধিকার ও আন্দোলনে উচ্চারিত হচ্ছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠনের নেতারা স্লোগানটি ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইনকিলাব জিন্দাবাদ একটি শক্তিশালী আন্দোলন ও প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। স্লোগানটির গভীর প্রভাব এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বর্তমান বাংলাদেশে বিরাজ করছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের দ্বারা গঠিত নতুন দল - জাতীয় নাগরিক পার্টিও 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগানটি রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে নিয়েছেন।
0 Comments