ভারত বাংলাদেশ ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ব্যাপক ও ভয়াবহ প্রতিকার প্রভাব সৃষ্টি করেছে। উজানের দেশ ভারত কলকাতা বন্দর কে পলির হাত থেকে রক্ষা করতে প্রায় আঠারো মাইল উজানে মনোহরপুর এর কাছে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। ভারত বাংলাদেশের পদ্মা বা গঙ্গার পানি ভারতের একতরফা প্রত্যাহার বাংলাদেশের পরিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংস এবং কৃষি, শিল্প, বণসম্পদ ও নৌযোগাযোগের অর্থনৈতিক খাতগুলির ওপর হুমকি স্বরূপ। আজকে আর্টিকেলে ভারত বাংলাদেশ ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে তথ্য দিয়ে আপনাদের সাহায্য করার চেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ।
বাংলাদেশ ভারত ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে তথ্য || Bangladesh India Information about Farakka Dam
ভারত বাংলাদেশ ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে তথ্য যেমন ফারাক্কা বাঁধ কোথায় অবস্থিত , ফারাক্কা বাঁধ চালু হয় কবে?, ফারাক্কা বাঁধের দৈর্ঘ্য কত?,ভারত বাংলাদেশ ফারাক্কা বাঁধের গেট কয়টি, বাংলাদেশের উপর ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাব, ফারাক্কা বাঁধের উপকারিতা, ফারাক্কা লং মার্চ কার নেতৃত্বে হয়, ফারাক্কা পানি বন্টন চুক্তি কত সালে স্বাক্ষরিত হয় এবং বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব কত কিলোমিটার? এ সম্পর্কে তথ্য আলোচনা করা হলো।
ফারাক্কা বাঁধ কোথায় অবস্থিত
ভারত বাংলাদেশ ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা/পদ্মা নদীর উপর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। ১৯৬১ সালে ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৭৫ সালে শেষ হয়। ১৯৭৫ সালের ২১শে এপ্রিল ফারাক্কা বাঁধ চালু হয়। ২,২৪০ (৭,৩৫০ ফুট) মিটার লম্বা ফারাক্কা বাঁধটি সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি হয়েছিল। বাঁধ থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ২৫ মাইল (৪০ কিলোমিটার)।
হুগলি নদীতে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে পলি জমা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।ভারত এই পলি নিষ্কাশনের উদ্দেশ্যে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে। শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে জুন) ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গার ৪০,০০০ ঘনফুট/সে (১,১০০ মি৩/সে) পানি হুগলি নদীর অভিমুখে প্রবাহিত করে।
ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য কি ছিল?
ফারাক্কা বাঁধের মূল উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথী নদীর পানির অভাবে পলি জমা হয়ে হারিয়ে যেতে বসা নাব্যতাকে পুনরায় পদ্মা / গঙ্গার পানি দ্বারা পুষ্ট করে, দিন দিন নব্যতা হারিয়ে যাওয়া কলকাতা বন্দরকে পূর্বের ন্যায় কার্যক্ষম করে তোলা। অর্থাৎ কলকাতা বন্দরের ভাগীরথী নদীর পলি জমা থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। এটি প্রায় ১৮ কি.মি লম্বা মনোহরপুরের কাছে অবস্থিত।
যদিও তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন যে গঙ্গা/পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। এ ধরনের নেতিবাচক অভিমত সত্ত্বেও ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খালখননের পরিকল্পনা ও কাজ শুরু করে । যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে ।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস
তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতা বন্দরে পলি সঞ্চয়ের কারণে জাহাজ ভিড়ানোর অসুবিধা লক্ষ্য করেছিল। কেননা পদ্মা / গঙ্গা নদীর শাখানদী ভাগীরথী- হুগলী নদী ক্রমশঃ নাব্যতা হারাচ্ছিল। ১৮৫১ - ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। কারণ কলকাতা বন্দরে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে গঙ্গার পানির এক অংশ ঘুরিয়ে কীভাবে হুগলী-ভাগরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়।
শ্রী কপিল ভট্টাচার্য তৎকালীন ভারতের পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার গঙ্গা হতে হুগলী-ভাগীরথী ফিডার খাল পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। তিনি বলেন-
➡️ পদ্মা / গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক পানি ফিডার খাল কিংবা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না। ফলে মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা জুড়ে দেখা দিবে জলাবদ্ধতা।
➡️ পদ্মা / গঙ্গা এবং ভাগীরথী নদীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে পানি পরিচালন কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে।
➡️ ব্রক্ষপুত্র নদের তুলনায় পদ্মা / গঙ্গা কম গতি সম্পন্ন নদী। এ ধরনের নদীর গতিপথ হয় আঁকা-বাঁকা (meandering -এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকের দূরত্বকে বলে মিয়ান্ডার দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়টা বাঁক রয়েছে তাকে বলে মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি)। মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগরথীর মধ্য দিয়ে হঠাৎ করে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে পানি প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগরথী ও উজানে বিহার পর্যন্ত সব নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ফলে ঐ সকল নদীতে জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙ্গন এবং চর সৃষ্টি তরান্বিত হবে।
➡️ এছাড়াও ভাটি অঞ্চলের সকল নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ কম হওয়ার ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিবে।
ফারাক্কা বাঁধ চালু হয় কবে?
ভারত বাংলাদেশ গঙ্গা/পদ্মা নদীর উপর অবস্থিত ফারাক্কা বাঁধ ১৯৭৫ সালের ২১ শে এপ্রিল চালু হয়।
ফারাক্কা বাঁধের গেট কয়টি
ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ করে হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি । ভারত নির্মিত ফারাক্কা বাঁধে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ থেকেই ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি সরবরাহ করা হয়। ফারাক্কা বাঁধ শুধু বাঁধ নয় ; বরং এই বাঁধের উপর দিয়ে ৩৪নং জাতীয় সড়ক ও রেলপথ গিয়েছে। যা ভারতের উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গক এবং উত্তরপূর্ব অংশকে বাকী ভারতের সঙ্গে জুড়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
ফারাক্কা পানি বন্টন চুক্তি কত সালে স্বাক্ষরিত হয়
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭১ সালে ভারতের সাথে পদ্মা/গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে ফারাক্কা পয়েন্টে পদ্মা/গঙ্গার পানি বন্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন।
বাংলাদেশ ভারত ফারাক্কা পয়েন্টে এ যৌথ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। যদিও বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ২১মে পর্যন্ত ১০ দিনের জন্য ভারতকে পদ্মা/গঙ্গা হতে ৩১০-৪৫০ কিউসেপ পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়।
১৫ ই আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর ভারত কোনরকম আলোচনায় না এসেই ১৯৭৬ সালের শুষ্ক ও মৌসুম পর্যন্ত ১১৩০ কিউসেপ পানি গঙ্গা হতে অপসারণ করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে।
বাংলাদেশ ভারতকে পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে এ বিষয়টি জাতিসংঘ উপস্থাপন করে। ১৯৭৬ সালের ২৬ শে নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সাথে আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি শুরু করার নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাবনা গ্রহণ করে। এরপরে বেশ কয়েকবার বৈঠক হয়।
১৯৭৭ সালের ৫ই নভেম্বর বাংলাদেশ ভারত একটি চুক্তি করে। সাতাত্তরের চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ১৯৭৮ থেকে১৯৮২ সাল পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে।
১৯৮২ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ভারত ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালের পানি বন্টনের একটি চুক্তি করে। ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে আরো তিন বছরের জন্য ১৯৮৬ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত পানি বন্টনের চুক্তি হয়। কিন্তু একটি দীর্ঘ চুক্তির অভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পানি ব্যবহারের কোন দিরও পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
ফলে ১৯৮৯ সালে শুষ্ক মৌসুমে কোন চুক্তি না থাকায় ভারত একতরফা প্রচুর পরিমাণ পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নেয়; যার ফলে বাংলাদেশের নদ নদীতে পানি প্রবাহের চরম অবনতি ঘটে। ১৯৯২ সালের মে মাসে তৎকালীন দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বাস দিয়েছিল যে বাংলাদেশ-ভারত সমান পরিমাণে পানির দেবার ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল কিছু করবে। কিন্তু পরবর্তীতে পানি বন্টন নিয়ে মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে আর কোন বৈঠক হয়নি।
১৯৯৩ সালের মার্চ মাসের দিকে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর পানি প্রবাহের আরো অবনতি হয়। তখনকার বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অঞ্চলে মাত্র ২৬১ কিউসেফ পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। যা ফারাক্কা-পূর্ব সময় ১৯৮০ কিউসেফ পানি প্রবাহিত হতো। ১৯৯৩ সালের মে মাসে পুনরায় বাংলাদেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া কথা রাখতে ব্যর্থ হয়।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হয়। এ সালের ডিসেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব কত কিলোমিটার?
বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত হতে বাংলাদেশ ভারত ফারাক্কা বাঁধ ভারতের প্রায় ১৮ কিলোমিটার অভ্যন্তরে মনোহরপুরের কাছে অবস্থিত।
বাংলাদেশের উপর ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাব
ভারতের উপর ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাব
ফারাক্কা লং মার্চ কার নেতৃত্বে হয়
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা লং মার্চ হয়। এ সময় ভাসানীর বয়স ছিল ৯০ বছরের ঊর্ধ্বে। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে ১৯৭৬ সালের শুরুর দিকে কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মাওলানা ভাসানী ১৮ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ফেরার পর বাংলাদেশের পানি অধিকার নিয়ে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাহলে তিনি লং মার্চ করবেন।
মাওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে রাজশাহী শহর থেকে লং মার্ক করার ঘোষণা দেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাওলানা ভাসানীকে প্রদান করে ২রা মে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট 'ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা জাতীয় কমিটি' গঠিত হয়। ক্রমশ কমিটির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
মজলুম জননেতা মাওলানা হামিদ খান ভাসানী নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে রাজশাহী শহর থেকে ফারাক্কা অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। এ লং মার্চ সম্মেলনে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়। এ সময় মাওলানা হামিদ খান ভাসানী নেতৃত্বে ৬৪ কিলোমিটার যাত্রা করে ভারতের সীমান্তের কিছুটা আগে লং মার্চ সমাপ্ত করেন।
0 Comments