প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়মের ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ একটি দুর্যোগ প্রবণ দেশ। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, ভূমির বৈশিষ্ট্য, নদীর বহুবিধতা এবং মৌসুমী জলবায়ু প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিকম্প, ভূমিধস, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, হারিকেন, তুষারপাত,টর্নেডো,  সুনামি, মহামারী, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা প্রভৃতির মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা।


সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। তাই আজকে আর্টিকেলটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয় এ বিষয়ে সাজানো হয়েছে। 


প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয়



প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম। যা সংঘটিত হলে মানুষ আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের সৃষ্ট কর্মকাণ্ডের প্রভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হয়, যার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে থাকে। 


বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূমির বৈশিষ্ট্য, নদীর আধিক্য এবং মেঘালয় পর্বত থেকে নেমে আসা মৌসুমী বায়ুর প্রভাবই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী। বছরের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যায় ।সবচেয়ে বেশি দুর্যোগের শিকার হয় উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা। 


বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো খরা, নদীভাঙন, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, পাহাড়ি ভূমিধ্বস ও বন্যা। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের অধিবাসীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খরা, নদীভাঙন এবং বন্যার প্রভাবে। প্রতি বছর কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে দেশের মানুষের জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। 


তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয় হলো প্রথমত দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও দুর্যোগ প্রবণ এলাকার ঝুঁকি কমানোর জন্য  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল গ্রহণ করা। যদিও বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় দুর্যোগপূর্ব পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে  এটুকুই যথেষ্ট নয়।


বাংলাদেশ নদীমাতৃক একটি ব-দ্বীপ। সীমান্তবর্তী উজানের দেশ ভারতের সাথে ভাটির দেশ বাংলাদেশর ৫০টির বেশি  অভিন্ন নদী রয়েছে। যার স্বাভাবিক গতিপথে একাধিক ভারতের তৈরিকৃত বাঁধ যা নদীর স্বাভাবিক নাব্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে। যার ফলে বাংলাদেশের উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবনতা বেশি দেখা যায়।  তারমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিস্তা নদীর বুকে ফারাক্কা ব্যারেজ। যা শুকনো মৌসুমে মরুভূমি এবং বর্ষা মৌসুমে বন্যার সৃষ্টি করে। 


সাম্প্রতিক সময়ে গোমতী নদীর বুকে ডুম্বুর বাঁধ দিয়ে ভারত থেকে আশা পানি বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের অন্যতম করণীয় হলো যতদ্রুত সময়ে সম্ভব তিস্তা- পদ্মা / গঙ্গাসহ যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া।


বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শুধু ফারাক্কা বাঁধই নয়, তিস্তাসহ প্রায় সবক’টি নদীর অবকাঠামোগত উন্নয়ন মনিটরিং করা দরকার। এক্ষেত্রে ওয়াটার ডিপ্লোম্যাসি আরো জোরদার করা বাঞ্ছনীয়।


বাংলাদেশ যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে দুর্যোগপ্রবণ দেশ, তাই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ ও যথাযথ প্রস্তুতির বিকল্প নেই। 


বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের নদীগুলোতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা আত্যবশ্যক। কেননা নিম্নমানের বাঁধ নির্মাণের ফলে জোয়ারের পানি ও ঝড়-বৃষ্টিতেই বাঁধ নাজুক হয়ে পড়ে এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলো বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়।


এছাড়াও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবেলায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও সঠিক বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। যেমন  নদীর নাব্যতা বাড়ানো। নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে উন্নত প্রযুক্তিতে ড্রেজিং করে নদীর গতিপথে জমে থাকা পলি অপসারণ করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা। 


বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবেলায় মানুষের সৃষ্টি জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।যেমন- নদী ভরাট,খাল-বিল ও হাওড়সহ অন্যান্য জলাভূমি দখলমুক্ত করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ তৈরি করতে হবে। 


প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের   পলিসি-প্রাকটিস গ্যাপটা কমানো জরুরি। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালার প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে।


কেননা, জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯ তে বর্ণিত অংশীদার ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনাসহ বেশিভাগ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ফ্লাড একশন প্লান বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ের উপর কম গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তাই প্রথাগত ব্যবস্থার বাইরে যেয়ে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের    ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির সঙ্গে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানেরও প্রয়োগ করা প্রয়োজন।


আইপিসিসি'র পঞ্চম আসেসমেন্টের প্রতিবেদন অনুসারে জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের টেকসই দুর্যোগ মোকাবেলা অনেকটাই নির্ভর করছে আমরা কতটা জোর দিচ্ছি প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের উপর।


এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সফল না হলে নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাত-সহিষ্ণু সমৃদ্ধ বদ্বীপ গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়বে।



দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয়


প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যাকবলিত অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। যেমন - মানুষের ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, গবাদিপশু-পাখি, গাছ-গাছালি, আবাদি জমি, কৃষকের ফসল, পুকুর ও ঘেরের মাছ এবং বিদ্যুৎ সেবা ও মোবাইল নেটওয়ার্কিং সেবা প্রভৃতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরবর্তী করণীয় একটি বড় চ্যালেঞ্জ।



প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরবর্তী করণীয় নিম্নে দেওয়া হলো- 

১. রাস্তা-ঘাটের ওপর উপড়ে পড়া গাছপালা সরিয়ে ফেলুন যাতে সহজে সাহায্যকারী দল আসতে পারে এবং দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব হয়।


২. আশ্রয়কেন্দ্র হতে মানুষকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করুন এবং নিজের বাড়িতে বা গ্রামে অন্যদের মাথা গোঁজর ঠাঁই করে দিন।


৩. অতি দ্রুত উদ্ধার দল নিয়ে খাল, নদী, পুকুর ও সমুদ্রে ভাসা বা বনাঞ্চলে বা কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করুন।


৪. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ যাতে শুধু এনজিও বা সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় বসে না থেকে নিজে যেন অন্যকে সাহায্য করে সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।


৫. রিলিফের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সচেষ্ট হোন। রিলিফের পরিবর্তে কাজ করুন। কাজের সুযোগ সৃষ্টি করুন। রিলিফ যেন মানুষকে কর্মবিমুখ না করে কাজে উৎসাহি করে সেভাবে রিলিফ বিতরণ করতে হবে।


৬. দ্বীপের বা চরের নিকটবর্তী কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারের জন্য দলবদ্ধ হয়ে দড়ি ও নৌকার সাহায্যে লোক উদ্ধারে কর্ম তৎপর হোন। কাদায় আটকে পড়া লোকের কাছে দড়ি বা বাঁশ পৌঁছে দিয়ে তাকে উদ্ধার কাজে সাহায্য করা যায়।


৭. ঝড় একটু কমলেই ঘর থেকে বের হবেন না। পরে আরও প্রবল বেগে অন্যদিক থেকে ঝড় আসার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

৮. পুকুরের বা নদীর পানি ফুটিয়ে পান করুন। অথবা পানি বিশুদ্ধকরণ ঔষধ দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করে পান করুন। বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখুন।

৯. নারী, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ লোকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ত্রাণ বন্টন (আলাদা লাইনে) করুন।

১০. দ্রুত উৎপাদনশীল ধান ও শাক-সব্জির জন্য জমি প্রস্তুত করুন,বীজ সংগ্রহ করুন এবং কৃষি কাজ শুরু করুন যাতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফসল ঘরে আসে।


এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত  জনসাধারণের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও সহায়তা প্রদান করতে হবে। পরবর্তী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি জারি রাখতে হবে এবং ক্ষয়ক্ষতির হতে বাঁচতে মানুষকে সচেতন করতে প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে।



বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনটি?

বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ২১ আগস্ট ২০২৪ সালের বন্যা। বাংলাদেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের জেলাসমূহ কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও আকস্মিক উজান থেকে নেমে আসা পানি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।


ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ায় এই আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি হয়। যদিও ভারতীয় হাই কমিশনার বলেন, অতিরিক্ত পানির চাপে বাঁধ নিজে থেকে খুলে যায়। এ বন্যায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৫৯ জন, নিখোঁজ রয়েছে ১ জন এবং ৫৮ লাখেরও বেশি মানুষ স্থানচ্যুত হয়। 

Post a Comment

0 Comments