আজ ১৪ই এপ্রি ল বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ। বৈশাখের প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষী সকল মানুষ পহেলা বৈশাখ পালনে বাঙালির প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠে। কিন্তু পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ কে চালু করেন কত সালে আজকের আর্টিকেলটির সে সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে।
আজকের এই বাংলা নববর্ষ কে কেন্দ্র করেই আমাদের আর্টিকেল সাজানো হয়েছে।আজকের আর্টিকেলে বাংলা নববর্ষ কে চালু করেন কত সালে, কে বাংলা নববর্ষ ১ লা বৈশাখ চালু করেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা কী এ সকল বিষয় তুলে ধরেছি।
বাংলা নববর্ষ কে চালু করেন কত সালে
বাংলা নববর্ষ চালু করেন মুঘল সম্রাজ্যের সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই মার্চ বা আরবি বছরের ৯৯২ হিজরিতে। তবে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের গণনা পদ্ধতি কার্যকর হয়।
বাংলাদেশের প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলা নববর্ষ উৎসবটি পালিত হয়। বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।
১৪ ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ নববর্ষের এই দিনটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে। তবে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ১৫ এপ্রিল চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে।
বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ দিনটিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছে। এই দিনে সকল অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকে; এবং সকলে বিভিন্ন রঙে ও নানা আয়োজনে মেতে ওঠে।ব্যবসায়ীরা নববর্ষের এই দিনটিকে নতুন ভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বাংলা নববর্ষকে নতুন রূপে বরণ করে নেয়।
সম্রাট আকবরের সময়কাল হতেই পহেলা বৈশাখ উৎসব পালিত হয়। তবে বাংলাদেশে ঢাকার মুসলিম মাহিফরাস সম্প্রদায়ের হাতে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়।
বাঙালির ঐতিহ্যবাহী বাংলা নববর্ষ বিভিন্ন উৎসব যেমন শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া, মেলা, হালখাতা খোলা এবং বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়।
বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বিনিময় বাক্য- 'শুভ নববর্ষ'।নববর্ষের দিনটিতে বাংলাদেশে বিভিন্ন পশু পাখির প্রতিকৃতি হাতে নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ' মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য' হিসেবে ঘোষণা দেয়।
বরাবরের ন্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষ্ঠানের উদ্যোগে, বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা সকাল ৯ টা থেকে শুরু হবে। তবে এবারের শোভাযাত্রায় থাকছে ভিন্নতা। এবারের শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো - 'নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান'।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস
গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু হয়। সৌর পঞ্জিকা অনুসারে অনেক আগে থেকেই বাংলা ১২ মাস পালিত হয়ে আসছে। আর এই সৌরপঞ্জিকা শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে।
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করা হত আরবি বছর হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে। আরবি হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফসলের ফলনের সময়ের সঙ্গে মিল পেতে অসুবিধা হয়। সে প্রেক্ষাপটে তখনকার মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট আকবর কৃষি কাজের সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
সম্রাট আকবরের আদেশে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমির উল্লাহ সিরাজী আরবি হিজরী সন ও সৌর বছরের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের গণনা তৈরির কাজ শুরু করেন।
নববর্ষ গণনার বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই মার্চ বা আরবি বছরের ৯৯২ হিজরিতে গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এ গণনা পদ্ধতিকে ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের তারিখ থেকে কার্যকর ধরা হয়। বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ নামে পরিচিত হওয়ার আগে গণনার শুরুর দিকে একে ফসলি সন বলা হত।
ইসলামী ও হিন্দু পঞ্জিকা এর সমন্বয় করে সম্রাট আকবরই বাংলা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের সিদ্ধান্তে বাংলা পঞ্জিকার সাথে কৃষি ফলনে বছরের সময় মিলিয়ে দেওয়ায় পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ পরবর্তীকালে উৎসবে পরিণত হয়।
সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত এ পঞ্জিকার নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহী এবং পঞ্জিকার ১২ মাসের নাম গুলো ছিল- অর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর প্রভৃতি। আকবরের তারিখ-এ-এলাহী পরবর্তীকালে বাংলা বঙ্গাব্দ রূপে চালু হয়।
তবে বাংলা মাসের অর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর নামগুলো পরিবর্তিত হয়ে কখন যে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ নামে নামকরণ হয় সে সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত বলতে পারেন না। কিন্তু ধারণা করা হয় বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে।
কে বাংলা নববর্ষ ১ লা বৈশাখ চালু করেন
পহেলা বৈশাখ প্রথম কে চালু করেছিলেন
মঙ্গল শোভাযাত্রা কী
বাংলাদেশের বৈশাখী বা নববর্ষ উৎসবের একটি আবশ্যিক বিষয় হল ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা পহেলা বৈশাখের সকালে শোভাযাত্রা নিয়ে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ করে।
এই মঙ্গল শোভাযাত্রা সঙ্গে স্বীকৃতি উৎসবের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষা ও হয়ে ওঠে। এই শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলা ও গ্রামীণ জীবন কে ফুটিয়ে তোলা হয়।
পহেলা বৈশাখের সূর্যোদয়ের পর থেকে রমনার বটমূল, টিএসসি ও শাহবাগে মানুষের উপচে পড়া ভিড় হয় তখন সকল শ্রেণীর পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ শোভাযাত্রার জন্য বানানো বিভিন্ন রঙের পশুপাখির প্রতিকৃতির মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করে।
১৯৮৯ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এর শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এ মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু হয়। সেই থেকে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি অন্যতম আকর্ষণ ও উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
২০১৬ সালের ৩০ শে নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকা অন্তর্ভুক্ত করে।
আজ পহেলা বৈশাখ সকাল ৯ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এর উদ্যোগে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হবে। পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা শুধু আবহমান বাংলা ও গ্রামীণ জীবনের সংস্কৃতি তুলে ধরে না বরং এটি একটি সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক চরিত্রও ফুটিয়ে তোলে।
0 Comments