বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রধান নদী পদ্মা।বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে থেকে বাংলাদেশের প্রবেশের আগ পর্যন্ত প্রবাহপথের উবায় দিক থেকে আসা বহু নদ নদীর দ্বারা সমৃদ্ধ ভারতের গঙ্গা নদী। বাংলাদেশের পদ্মা নদী ভারতের গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা।
আজকে আর্টিকেলের মূল বিষয়বস্তু হলো পদ্মা নদীকে ঘিরে। যেমন বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায় , পদ্মা নদীর নামকরণের ইতিহাস, পদ্মা নদী কতটি জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, পদ্মা নদীর আয়তন কত, পদ্মা নদী বাংলাদেশের কোন অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করেছে অর্থাৎ বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায় থেকে শুরু করে পদ্মা নদীর আদ্যোপান্ত আজকে আর্টিকেলে আলোচনার বিষয়।
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায়
উত্তর দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের হিমালয়ের সঞ্চিত বরফের আচ্ছাদন হিমবাহ হয়ে নেমে এসে অনেক নদ-নদী সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের উত্তরাখন্ডে হিমবাহ থেকে পাঁচটি শীর্ষ ধারা বেরিয়ে এসেছে। মন্দাকিনী ও অলকানন্দা এবং ধৌলি গঙ্গা ও পিন্ডারি এই চারটি প্রবাহ অলকানন্দা নামে প্রবাহিত হয়ে দেবপ্রয়াগ এসে ভাগীরথীর সঙ্গে মিলিত হয়ে গঙ্গা নাম ধারণ করেছে।
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করেছে। ভারতের গঙ্গা নদীর অন্য শাখাটি ভাগীরথী নামে ভারতের হুগলির দিকে প্রবাহিত হয়। গঙ্গা ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার গিরিয়ায় হুগলী এবং পদ্মা নামে দুটি শাখায় বিভক্ত।
বাংলাদেশের প্রবেশ করার পর গঙ্গা দক্ষিণ পূর্বমুখী পথে অগ্রসর হয়েছে। গঙ্গা নদী বাংলাদেশের প্রবেশের পর থেকে পদ্মা নামে পরিচিতি পেয়েছে। নদীর উৎপত্তিস্থল হতে ২২০০ কিলোমিটার দূরে গোয়ালন্দ যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে আরো পূর্ব দিকে চাঁদপুর জেলায় বাংলাদেশের প্রশস্ততম নদী মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।
পদ্মা মেঘনার মিলিত প্রবাহ মেঘনা নাম ধারণ করে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশে গেছে। এই ধারাটি গোয়ালন্দ পর্যন্ত গঙ্গা, এবং ভাগীরথী গঙ্গার শাখা নদী। মূলত বাংলাদেশের অংশটি গঙ্গার মূলধারা।
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর সাথে এ অঞ্চলের মানুষের অনেক সুখ দুঃখের লোককথা জড়িয়ে আছে। পদ্মার কড়াল গ্রাসে যেমন বিলীন হয়েছে অনেক মানুষের সহায় সম্বল তেমনি পদ্মা নদী বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পদ্মা বাংলাদেশের প্রধান যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ ও মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা ব্যারেজ এর প্রভাবে পদ্মা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙ্গন সহ ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয় অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদী বালুচরে পরিণত হয়। এতে পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে।
পদ্মা নদীর অতীত ও বর্তমান অবস্থা
হিমালয় থেকে উৎপত্তি নদীর গতিপথ বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে যেমন সমৃদ্ধ নানা শহর গড়ে উঠেছিল তেমনি নদীর ভয়াল গ্রাসে তা আবার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যার ফলে বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের অতীত চিহ্ন খুব কমই দেখা যায়।
গঙ্গা নদীর বর্তমান গতিপথ ষোড়শ শতাব্দীতে ভিন্ন ছিল। তখনকার সময়ের গঙ্গা /পদ্মা নদী আরো উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এসে গৌর শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো। ভারতের বর্তমান ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পূর্বে গঙ্গার পানি মূলত বাংলাদেশের পদ্মা নদী দিয়েই প্রবাহিত হতো। আজ থেকে প্রায় পাঁচশত বছর আগে ভাগীরথী ছিল গঙ্গার প্রবাহ পথ।
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর গতিপথ গত চারশো বছরে বেশ পরিবর্তিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, পদ্মা নদীর গতিপথ রামপুর বোয়ালিয়ার পাশ দিয়ে, চলন বিলের মধ্য দিয়ে ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার মধ্য দিয়ে ঢাকা নগরী অতিক্রম করে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে।
বাংলাদেশের পদ্মা নদী অষ্টাদশ শতাব্দীতে পদ্মার নিম্ন অববাহিকা ছিল বর্তমান গতিপথের অনেক দক্ষিনে। সে সময়ে পদ্মা নদী ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বর্তমান চাঁদপুরের প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিনে শাহাবাজপুর দ্বীপের উত্তরে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছিল।
পদ্মা নদীর বাম তীরে বিখ্যাত নগরী রাজনগর এবং এর নিকটেই কালিগঙ্গা নদী মেঘনা নদী ও পদ্মা নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতো। বর্তমান ব্রহ্মপুত্র নদ যমুনা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দের নিকট পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পূর্বে গারো পর্বতমালার পশ্চিম দিক দিয়ে পূর্ব দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ধলেশ্বরী নদীর সাথে মিলিত হতো।
পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য কত
পদ্মা নদী কতটি জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে রাজশাহী জেলা থেকে প্রবেশ করে বাংলাদেশের তিনটি বিভাগের মোট ১২ টি জেলার ভিতর দিয়ে ৩৪১ কিলোমিটারের পদ্মা নদী প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর প্রবাহিত জেলাগুলো হলো -রাজশাহী, মুন্সিগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মাদারিপুর, নবাবগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর এবং চাঁদপুর।
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপনদী
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর প্রধান উপনদী মহানন্দা এবং পুনর্ভবা। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর প্রধান উপনদী মহানন্দা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর প্রধান অন্য উপনদী পুনর্ভবা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর শাখা নদী
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর বেশ কিছু শাখা নদী রয়েছে। পদ্মা নদীর বিভিন্ন শাখা নদীর মধ্যে বড়াল, আড়িয়াল খাঁ, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, কপোতাক্ষ এবং কুমার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বাংলাদেশের পদ্মা নদীর শাখা নদী ছাড়াও বেশ কিছু প্রশাখা নদী রয়েছে। তার মধ্যে মধুমতি, পশুর, এবং ভৈরব ইত্যাদি।
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর শাখা নদী এবং প্রশাখা নদী গুলো কুষ্টিয়া, যশোর, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, নড়াইল মাগুরা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালী, মাদারীপুর এবং শরীয়তপুর জেলার উপর দিয়ে বিস্তৃত লাভ করেছে।
পদ্মা নদীর নামকরণের ইতিহাস
প্রাচীন বাংলায় হিন্দুদের বসবাস ছিল। তখনকার হিন্দু অধিবাসীরা তাদের দেব দেবীর নামে নদ-নদী সহ বিভিন্ন গ্রাম, শহর ও স্থাপনার নামকরণ করত। ভারতের গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা নদী পদ্মা নদীর নামকরণ করা হয় হিন্দুদের লক্ষ্মী দেবীর নাম অনুসারে। লক্ষ্মী দেবীর আরেক নাম পদ্মা। লক্ষ্মী দেবী পদ্ম ফুলের মাঝে প্রকাশিত হয়েছেন। পদ্ম ফুলের সংস্কৃত পদ্মা। যা প্রাচীন হিন্দু লিপিতে দেবী লক্ষ্মীর উপনাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের পদ্মা নদী কীর্তিনাশা নামেও পরিচিত। রাজা রাজবল্লবের কীর্তি পদ্মা নদীর ভাঙ্গনের মুখে পড়ে ধ্বংস হাওয়ায় পদ্মাকে কীর্তিনাশা বলেও ডাকা হয়। তখন থেকে পদ্মার আরেক নাম হয় কীর্তিনাশা।
পদ্মা নদীর নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিভিন্ন সময় কবি সাহিত্যিকদের বিশেষভাবে আকর্ষিত করেছে। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাহিত্যে লেখক কবিদের কলমে পদ্মা তীরবর্তী মানুষের জীবনযাপন, পদ্মার নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।
0 Comments