তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায় || Where is the source of river Teesta?

বাংলাদেশ ভারতের অন্তসীমান্ত তিস্তা নদী হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত সিকিম রাজ্যে এবং পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির করিডোর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত। তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের ২১ টি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড -এর রিপোর্ট অনুযায়ী তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের প্রদত্ত পরিচিতি হিসেবে ৫২ নম্বর নদী। 


তিস্তা নদী বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে কৃষি কাজ, পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন, মাছ চাষ এবং শিল্প কারখানার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আজকে আর্টিকেলে তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায় এবং তিস্তা নদীর সংক্ষিপ্ত তথ্য জানানোর চেষ্টা করব। 



তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায়



তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায়

হিমালয় পাদদেশে অবস্থিত সিকিমে তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল। সিকিমের৫,৩৩০মি. (১৭,৪৮৭ ফুট ) উচ্চতায় অবস্থিত সো লামো হ্রদ হতে তিস্তা নদীর উৎপত্তি হয়ে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে দার্জিলিং এর সমভূমিতে নেমে এসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলাতে প্রবেশ করে। বাংলাদেশ ভারতের অন্ত-সীমান্ত তিস্তা নদীটি নিলফামারী জেলার কালিগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। 



বাংলাদেশ ভারতের আন্তঃসীমান্ত তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির প্রধান নদী। সেজন্য তিস্তা নদীকে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের জীবনরেখা বলা হয়। তিস্তা নদী জলপাইগুড়ির দক্ষিণে পূর্ববর্তী সময়ে তিনটি ধারায় যেমন-পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পুনর্ভবা এবং মধ্যে আত্রাই ইত্যাদি প্রবাহিত হতো। এই তিনটি ধারায় প্রবাহিত হওয়ায় 'ত্রি-স্রোত' বা 'তিন প্রবাহ' থেকে তিস্তা নামকরণ হয়েছে। 



তিস্তা নদী ছাঙ্গু, ইউমথাং ও ডংকিয়া লা পর্বতশ্রেণী হতে উৎপন্ন ছোট ছোট নদীর জলে পুষ্ট। ইফতার পথে বিভিন্ন ধরনের বনভূমি দেখা যায়। তিস্তার নিম্ন অববাহিকায় ক্রান্তীয় পর্ণমতি ও গুল্ম শ্রেণীর গাছপালা বেশি দেখা যায়। তিস্তার উচ্চ অববাহিকায় আলটিও বনভূমি দেখা যায়। এবং নদীর উপত্যকায় প্রচুর সাদা বালি (যা নির্মাণ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়), পানির মধ্যে বড় বড় বোল্ডার দেখা যায়। 



তিস্তা নদী দেখতে শান্ত হলেও এর গভীরের পানি বেশ খরস্রোতা। বর্ষা মৌসুমী বাংলাদেশ ভারতের দুপুর ছাপিয়ে বন্যায় প্লাবিত হয়। এ সময় তিস্তার পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি ধস সৃষ্টি হয়। যা তিস্তার উপকূলবর্তী জনজীবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। 


বাংলার অনেক নদীর গতিপথ ১৫০০ সালের পর থেকে ভৌগোলিক কারণে পরিবর্তিত হয়েছে। তার মধ্যে তিস্তা নদীর একটি। তিস্তা নদী আগে জলপাইগুড়ির দক্ষিণে তিনটি ধারায় যেমন-পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পুনর্ভবা এবং মধ্যে আত্রাই ইফতারি প্রবাহিত হতো। সম্ভবত ত্রি স্রোতা নামটি এই তিনটি ধারায় অনুষ্ঙ্গেই এসেছিল যা কালের বিবর্তনে তিস্তা রূপ লাভ করে। 


তিস্তা নদীর এই তিনটি ধারার মধ্যে পুনরভা মহানন্দায় , আত্রাই চলন বিলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করতোয়ার সাথে মিলতো। আত্রাই-করতোয়ার একত্রে ধারাটি জাফরগঞ্জের কাছে পদ্মার সাথে মিলতো। ১৭৮৭ সালের এক বিধ্বংসী কারণের পর তিস্তা নদী তার পুরানো থাক পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পূর্ব দিক হতে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলেছে। 



তিস্তা নদীর গিরিখাত কোথায় দেখা যায়?

তিস্তা নদী পার্বত্য অঞ্চল সিকিমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তিস্তা নদীর অনেকগুলো গিরিখাত সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল উত্তর সিকিম হিমালয় পর্বতমালার ৫,৩৩০মি. (১৭,৪৮৭ ফুট ) উচ্চতায় অবস্থিত সো লামো হ্রদটি শেসচেনের কাছে ডংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত। 



তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি

তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি বিষয়ে ১৯৮৩ সালে জুলাই মাসে বাংলাদেশ ভারতের মন্ত্রী পরিষদ পর্যায়ে এক বৈঠক হয়। এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ পানি নদীতে সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু তিস্তা নদীর পানি কিভাবে বন্টন হবে সে বিষয়ে কোন দিক নির্দেশনা ছিল না। 


বহু বছর পরে ২০০৭ সালের ২৫-২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ভারত বাংলাদেশ একটি যৌথ বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমবন্টন অর্থাৎ তিস্তার ৮০ শতাংশ পানির চল্লিশ শতাংশ ভারত এবং ৪০ শতাংশ বাংলাদেশে বাকি জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারতের প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করে। 


ভারত বাংলাদেশের নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গজলডোবা বাদ নির্মাণ করে বাংলাদেশের তিস্তার নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের তিস্তা নদীর অংশে তিস্তা নদীর মূল জলপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ আসতে বাধা দেয়া হয়। এবং ভারত ২০১৪ সালে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। 


ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরে গেছে। ভারত পানি বন্টনের ব্যাপারে একঘেয়েমি অনৈতিক ঢিলামির জন্য বাংলাদেশ অংশের তিস্তার আশেপাশের কৃষি জমি রুক্ষ হয়ে গেছে। তিস্তার তলদেশে অজস্র নুড়ি পাথর বালি ও পলি জমে তিস্তা শুষ্ক মৌসুমে উত্তপ্ত বালুর স্তূপে পরিণত হয়। 


অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে তিস্তার মূল গতিপথ পরিবর্তন করে তিস্তার পানি প্রবল বেগে দুই তীরে আছড়ে পড়ে। ফলে প্রতিবছর তিস্তা তীরবর্তী বাংলাদেশের জেলা সমূহ প্রায় ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর গাছপালা আবাদি জমি হারিয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত হয়।



তিস্তা বাঁধ কে নির্মাণ করেন?

১৯৯৬ সালে ভারত সরকার তিস্তা নদীর উপর তিস্তা বাঁধ নির্মাণ করেন। এ বাঁধের  মাধ্যমে ভারত সরকার তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে।  এই বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানি মহানন্দা নদী দিয়ে প্রবাহিত করে অসংখ্য খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় পানি সরবরাহ করে কৃষি উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে।



তিস্তা বাঁধ বাংলাদেশ থেকে কত দূরে?

তিস্তা বাঁধ বাংলাদেশ থেকে ৬০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত। ভারত সরকার ১৯৯৬ সালে তিস্তা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা নদীর উপর গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে।


তিস্তা নদীর প্রভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা হলো ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অতি বৃষ্টির পানি ও বন্যার কারণে ভারত গজলডোবা বাদসহ গোমতী নদীর উপর ডুম্বুর বাদ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের ১১ টি জেলা বন্যায় প্লাবিত হয় এবং এতে ৫২ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 


বর্তমান বাংলাদেশের তিস্তার প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা মরুভূমিতে রূপ নেয়। ফলে তিস্তা উপকূলবর্তী এলাকায় কৃষিকাজ এবং মৎস্য চাষ বন্ধ হয়ে যায় পানির অভাবে। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে তিস্তার অতিরিক্ত পানির প্রভাবে উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়। ফলে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

Post a Comment

0 Comments