মাওলানা ভাসানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী

ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একজন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ছিলেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার অনুসারীদের কাছে মাওলানা ভাসানী নামে পরিচিত ছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মাওলানা ভাসানী। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পরও পাকিস্তান শাসনামলে মাওলানা ভাসানী রাজনৈতিকভাবে বেশ জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ছিলেন। আজকে আর্টিকেলটি  মাওলানা ভাসানের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং কিছু তথ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে। 



মাওলানা ভাসানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী



মাওলানা ভাসানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী || Brief Biography of Maulana Bhasani

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০ - ১৯৭৬) বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ এবং গণআন্দোলনের নায়ক ছিলেন। তার অনুসারীদের কাছে তিনি মাওলানা ভাসানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মানুষের কাছে 'মজলুম জননেতা' হিসেবে সমধিক পরিচিত। দেশ বিভাজনের ফলে ১৯৪৭ সালের সৃষ্ট পাকিস্তানি আমল এবং ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। 


মাওলানা ভাসানী ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ও তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাওলানা ভাসানী বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় তার অনুসারীর অনেকে মাওলানা ভাসানীকে 'রেড মাওলানা' নামেও ডাকতেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা।


মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানে কৃষকদের জন্য কৃষক পার্টি করার জন্য সারা দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্র গঠনও এটা তিনি পঞ্চাশের দশকেই  নিশ্চিত হয়েছিলেন। 


১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের 'আস সালামু য়ালাইকুম' বলে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘন্টা বাজিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। 


১৯৭১ সালের ৯ মার্চ মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশ জাতীয় উদ্বোধন গঠন করার জন্য আহ্বান করেন। ১৯৭৬ সালে মাওলানা ভাসানী নেতৃত্বে ফারাক্কা লং মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তার বয়স ছিল ৯০ বছরেরও বেশি। মাওলানা ভাসানী বার্ধক্য জনিত কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।



মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্মস্থান

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ই ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী শারাফত আলী। মাওলানা ভাসানী চার ভাই বোনে ছিলেন। তিন ভাই এক বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। মাওলানা ভাসানের ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া। মাওলানা ভাসানী ছোটবেলায় তার বাবা মারা যান।  তার কিছুদিন পর তার মা এবং দুই ভাই মারা যায়। পিতৃহীন ও মাতৃহীন ছোট্ট শিশু হামিদ বেঁচে থাকেন। 



মাওলানা ভাসানী কোথায় পড়ালেখা করেছেন?

পিতৃহীন ছোট্ট শিশু হামিদ কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয় ছিলেন। সে সময় নাসির উদ্দিন বোগদাদীস ইরাকের এক আলেম ও ধর্মপ্রচারক সিরাজগঞ্জে আসেন তখন মাওলানা ভাসানী তার আশ্রয় কিছুদিন কাটান। 


১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর বাড়িতে যান মাওলানা ভাসানী। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের দায়িত্ব পালন করেন এবং জমিদারের ছেলে মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। 


১৮৯৭ সালে মাওলানা ভাসানী পীর সৈয়দ নাসির উদ্দিন এর সাথে আসাম চলে যান।হাজার ১৯০৩ সালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯০৭ সালে ইসলামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসাম ফিরে আসেন। 



মাওলানা ভাসানীর পরিবার

মাওলানা ভাসানী ১৯২৫ সালে জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। তিনি তার সহধর্মী কে নিয়ে ১৯২৬ সালে আসাম চলে যান। তিনি আসামে প্রথম কৃষক প্রচার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। মাওলানা ভাসানী এর স্ত্রী আলেমা খাতুন পাঁচবিবির জমিদার কর্তৃক পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সকল জমি মাওলানা ভাসানীর  জনকল্যাণমূলক কাজে দান করেন। আলেমা খাতুন ও ভাসানী দম্পত্তির চার সন্তানের মধ্যে দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে সন্তান ছিল। 


মাওলানা ভাসানীর তৃতীয় স্ত্রী হামিদা খানম ভাসানীর সাথে কৃষক সংগঠনের রেশ ধরেই পরিচয়। হামিদা খানম ১৯১৮ সালে বগুড়া জেলার আদমগিরি থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার  পিতা কাশেম উদ্দিন সরকার ছিলেন জমিদারশ্রেণীভুক্ত একজন সমাজ হিতোষী ধর্মপ্রাণ মুসলমান। 


হামিদা খানম ১৯৬৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি একটি ছেলে সন্তানও দুটি মেয়ে সন্তান রেখে যান। 



মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন

মাওলানা ভাসানী ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে তিনি অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে মাওলানা ভাসানী কংগ্রেসের যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ফলে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ১৯২৩ সালে স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে মাওলানা ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। 


মাওলানা ভাসানী ১৯২৯ সালে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন আসামের ধুবড়ি জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে । ভাসান চরে সম্মেলনর আয়োজন হওয়ায় তার অনুসারীরা তাকে 'ভাসানীর মাওলানা' নামে অভিহিত করেন।এখান থেকেই তার নামের সাথে যুক্ত হয় 'ভাসানী' শব্দটি। 


পরবর্তীতে মাওলানা ভাসানী কৃষকদের নিয়ে ১৯৩১ সালে কাগমারীতে , ১৯৩২ সালের সিরাজগঞ্জ এর কাওরাখোলায় এবং ১৯৩৩ সালে গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন।


মাওলানা ভাসানী ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস দল ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তখনকার আসামে 'লাইন প্রথা' চালু হলে এ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং 'আসাম চাষী মজুর সমিতি' গঠন করে ধুবরী , গোয়ালপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। 


১৯৪০ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে মাওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে 'বাঙ্গাল খেদাও ' আন্দোলনে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দিলে মাওলানা ভাসানী বাঙ্গালীদের রক্ষা করতে বারপেটা, গৌহাটীসহ আসামের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। 


১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আন্দোলনের অংশ নিলে মাওলানা ভাসানী আসামে গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৮ সালে তিনি মুক্তি পান। এরপরে তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন। মাওলানা ভাসানী ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে। 


একই সালের ১৭ই মার্চ মাওলানা ভাসানী স্পিকার এর কাছে দাবি জানায় যে ব্যবস্থাপক সবার কার্যাবলী বাংলায় পরিচালনা করার জন্য। ১৯ শে মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশগ্রহণ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেন , পূর্ববঙ্গ থেকে সংগৃহীত করের ৭৫ % প্রদেশকে দিতে হবে। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে কর ছিনিয়ে নিয়ে পূর্ববঙ্গ সরকারকে আর্থিকভাবে দুর্বল করে তোলে।


মাওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের সদস্য হওয়া সত্বেও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা তার উপর অখুশি হয় এবং মাওলানা ভাসানী নির্বাচনে তুরুটি ছিল বলে আদালতে মামলা দায়ের করা এবং তিনি বিভিন্নভাবে তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন। পরবর্তীতে ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপদ থেকে মাওলানা ভাসানী পদত্যাগ করেন। এতকিছুর পরেও মাওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশে। 


১৯৪৯ সালে ঢাকার টিকাটুলি রোজগার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন মাওলানা ভাসানী। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান এবং প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন মাওলানা ভাসানী। পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ২৩ শে জুন গঠিত হয়।সর্বসম্মতিক্রমে মাওলানা ভাসানী সভাপতি নির্বাচন হন। এ দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শামসুল হক নির্বাচিত হন এবং যৌথভাবে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং খন্দকার মোস্তাক নির্বাচিত হন। 


পূর্ববঙ্গে ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ১১ই অক্টোবর আরমানিটোলা ময়দানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে। এ জনসভায় খাদ্য সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করেন এবং মাওলানা ভাসানী ১৪৪ দ্বারা ভঙ্গ করে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। হলে ১৪ই অক্টোবর মাওলানা ভাসানী গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণ করেন। ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। 


১৯৫২ সালের ৩০ শে জানুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা জেলার ১২ লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার দাবির আন্দোলনে সহযোগিতা করায় মাওলানা ভাসানী পুনরায় গ্রেফতার হয় ১৬ মাস কারা নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৫৩ সালের ২১শে এপ্রিল জনমতের চাপে মাওলানা ভাসানীকে জেল মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। 


এরপর মাওলানা ভাসানী ১৯৫৩ সালের কৃষক শ্রমিক পার্টির যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৪ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে যোগদান এবং সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে বক্তব্য প্রদান, ১৯৫৫ সালের ২৫ এপ্রিল মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তন, পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষ হ্রদের জন্য সরকারের কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা দাবি আদায় ১৯৫৬ সালের অনশন ও ধর্মঘট এবং ১৯৫৬ সালের ১২ ই সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রিপাবলিকান পার্টির পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিত, ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলন এ মাওলানা ভাসানী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।


মাওলানা হামিদ খান ভাসানী পরবর্তী সময়ে ১৯৬২ সালে বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্য সহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ও ধর্মঘট, ১৯৬৩ সালে আইয়ুব খানের সাক্ষাৎ, ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ এবং সম্মিলিত বিরোধীদল গঠনে ভূমিকা ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতি সমর্থন জ্ঞাপন, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচির বিরোধিতা, ১৯৬৭ সালের কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারির প্রতিবাদ এবং চীনপন্থী ন্যাপ এর নেতৃত্ব গ্রহণ, ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন মাওলানা ভাসানী। 


মাওলানা ভাসানী ১৯৭০ সালে পল্টন ময়দানের এক জনসভায় 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবি উত্থাপনকরেন, ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান ,১৯৭২ সালের ২২শে জানুয়ারি মাওলানা ভাসানীর ভারত থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন, ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট পালন, ১৯৭৪ সালের হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন এবং আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দী হন মাওলানা ভাসানী, ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চ এ নেতৃত্ব দান এ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জীবনের ক্রান্তিকালে খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। 



মুক্তিযুদ্ধে মাওলানা ভাসানীর অবদান

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মাওলানা ভাসানী ভারতে চলে যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। মাওলানা ভাসানী ১৯৭১ সালে ১৮ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।  ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন মাওলানা ভাসানী।  ২৫ মার্চ রাতে সন্তোষে তার গৃহে মাওলানা ভাসানী  অবস্থান করছিলেন।মাওলানা ভাসানীর সন্তোষের বাড়িটি পাকিস্তান বাহিনী পুড়িয়ে দেয়।


মাওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান  পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে। মাওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হন। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মাওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে।


প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে মাওলানা ভাসানী  অনুরোধ করেন, তাকে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ নাকরার। উপরন্তু মাওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। মাওলানা ভাসানী ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল  সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন।


মাওলানা ভাসানী  ৩১শে মে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। মাওলানা ভাসানী ৭ জুন আর এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।


এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু'বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে,মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন -


 ১. তাজউদ্দীন আহমদ, 

২. মণি সিংহ, 

৩. অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, 

৪. মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ। 

মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।


মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিল্লি ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে অনেকে অভিযোগ করেন যে ভারতে থাকাকালীন তিনি নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে দিল্লি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করা হয়েছিল।


১৯৭২ সালের ২২ শে জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে তিনি সর্বপ্রথম যে দাবিটি তুলেন তা হল বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ। মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানকে সমর্থন করেন। 


মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন, "আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না। "



মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যু

১৯৭৬ সালের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।ভারতের নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে   লং মার্চ নেতৃত্বেদানের  কিছুদিন পরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে  ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে  ভর্তি হন। মাওলানা ভাসানীকে টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে সন্তোষ নামক স্থানে পীর শাহজামান দিঘির পাশে  সমাধিস্থ করা হয়। 

Post a Comment

0 Comments