বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি সে সম্পর্কে আইন বিশেষজ্ঞ ব্যতীত জনসাধারণেরও জ্ঞান রাখা আবশ্যক। কেননা আপনি গ্রেফতার হলে অথবা কখনো মামলা করলে বাংলাদেশের আইনের এই ধারা গুলো প্রয়োজন হয়ে থাকে।আইনের ধারা সম্পর্কে জানার আগে আমাদের জানতে হবে 'আইন কি?' আইন হলো- মানুষকে সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং সুশৃংখলভাবে জীবন পরিচালনার জন্য যে নিয়ম-কানুন তৈরি এবং প্রয়োগ করা হয়।
এছাড়াও আইন বলতে বোঝায় সামাজিকভাবে স্বীকৃত লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধান ও রীতিনীতি।বাংলাদেশের আইনের বেশ কিছু ধারা আছে। আজকে আর্টিকেলে আমরা বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি সে বিষয়ে জানব, ইনশাল্লাহ।
বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি
বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি আইনের ধারা রয়েছে। সমাজের এবং রাষ্ট্রে সৃষ্ট অপরাধ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জ্ঞান থাকলেও আইনের ধারা সম্পর্কে আইনের বিষয়ে অভিজ্ঞ ছাড়া সাধারণ জনগণের তেমন কোন ধারণা নেই বললেই চলে। অপরাধ কি সেটা আমরা সবাই জানি কিন্তু এই অপরাধের শাস্তিযোগ্য বাংলাদেশ আইনের ধারা সম্পর্কে আমাদের তেমন কোন ধারণা নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল তার পলিটিক্স (Politics) গ্রন্থে লিখেছিলেন , 'আইনের শাসন যেকোন ব্যক্তি শাসনের চেয়ে ভাল'। আর রাষ্ট্রীয় আইন হলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালার প্রেক্ষিতে সমাজে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধে সার্বজনীনভাবে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন নির্দেশ।
আজকে বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি এবং কোন ধারায় কোন বিধি বিধান রয়েছে সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করব। কেননা আপনার সাথে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে মামলা করার প্রয়োজনে বাংলাদেশের আইনের ধারা সম্পর্কে জানতে হবে। এছাড়াও কেউ যদি আপনাকে গ্রেফতার করতে আসে সে ক্ষেত্রেও আপনাকে বাংলাদেশের আইনের ধারা সম্পর্কে জানতে হবে।
বাংলাদেশের আইন কে প্রধানত তিনটি ভাগে চিহ্নিত করা যায়। এক. বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইন, দুই. ফৌজদারী কার্যবিধি এবং তিন. দেওয়ানী দন্ডবিধি। এই তিন শ্রেণীর আইনের মধ্যে ফৌজদারী কার্যবিধি এবং দেওয়ানী দন্ডবিধি আলাদাভাবে কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন নয়।
ফৌজদারী কার্যবিধি এবং দেওয়ানী দন্ডবিধি আইন একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে বিশেষ কিছু আইন তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি এ বিষয়ে এই তিন শ্রেণীর আইন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া হল।
১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইন
দন্ডবিধি আইনকে একটি দেশের মৌলিক আইন বলা হয়। ১৮৬০ সালে প্রথম ভারতীয় দণ্ডবিধি প্রবর্তিত হয়। বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ধারা রয়েছে মোট ৫১১ টি। এ ধারাগুলোর আবার অনেকগুলো উপধারা রয়েছে।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইন থেকে অপরাধ এবং অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে জানা যায়। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ধারাগুলোর কোনটিতে অপরাধের সংজ্ঞা বা বর্ণনা আবার কোনটিতে অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি এ বিষয়ে ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইনে মোট ৫১১ টি ধারা এবং ২৩ টি অধ্যায় রয়েছে। বাংলাদেশের আইনের দন্ডবিধির প্রথম শাস্তির ধারা ১০৯ এবং সর্বশেষ শাস্তির ধারা ৫১১ অনুযায়ী। বাংলাদেশের আইনের দন্ডবিধি ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০৩ ধারা অনুযায়ী এবং সবচেয়ে কম শাস্তি ৫১০ ধারা অনুযায়ী।
বাংলাদেশের আইনের ধারা সমূহের মৃত্যুদণ্ডের ধারা
১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা মৃত্যুদণ্ডের ধারা গুলো হলো— ১২১, ১৩২, ১৯৪, ৩০২, ৩০৩, ৩০৫, ৩০৭(২) এবং ৩৯৬।
বাংলাদেশের আইনের ধারা সমূহের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ধারা
বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি এ বিষয়ে ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ধারা গুলো হলো— ১২১, ১২১(ক ), ১২২, ১২৪(ক ), ১২৫, ১২৮, ১৩০, ১৩২, ১৯৪, ১৯৫, ২২৫, ২২৫(ক ), ২২৬, ২৩২, ২৩৩, ২৫৫, ৩০২, ৩০৪, ৩০৫, ৩০৭, ৩১১, ৩১২, ৩১৩, ৩১৪, ৩১৫, ৩২৬, ৩২৯, ৩৬৪, ৩৭১, ৩৭৬, ৩৭৭, ৩৮৮, ৩৮৯, ৩৯৪, ৩৯৬, ৪০০, ৪০৯, ৪১২, ৪১৩, ৪৩৬, ৪৩৭, ৪৪৯, ৪৫৯, ৪৬০, ৪৬৭, ৪৭২, ৪৭৪, ৪৭৫ এবং ৪৭৭।
বাংলাদেশের আইনের ধারা সমূহের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ধারা
বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি এ বিষয়ে ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইনের আওতাভুক্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ধারাগুলো হলো— ১২৬, ১২৭ এবং ১৬৯।
বাংলাদেশের আইনের ধারা সমূহের জরিমানা দন্ডবিধির ধারা
ফৌজদারী কার্যবিধি
অপরাধের তদন্ত করা, গ্রেফতার ও জামিনের বিধান, এবং বিচার কার্য পরিচালনা করা ফৌজদারী কার্যবিধি আইন থেকে জানা যায়। বাংলাদেশের আইনের ধারা অনুযায়ী ফৌজদারী কার্যবিধি আইনে মোট ৫৬৫ টি ধারা রয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধি এসব ধারার অনেকগুলো উপধারাও রয়েছে।
ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৬২ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে বলবৎ হয়। পরবর্তীতে ফৌজদারী কার্যবিধি ধারা বিভিন্ন সময় সংশোধনী আনা হয়। আবার কিছু ধারা বিভিন্ন সময় বাতিল করা হয়।
ফৌজদারী কার্যবিধির চতুর্থ ভাগ অপরাধের প্রতিরোধ বিষয় নিবেদিত। ফৌজদারী কার্যবিধিতে অপরাধ যাতে না ঘটতে পারে সে বিষয়ে কিছু আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। দন্ডবিধি এবং ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ধারার মধ্যে একটি সংযোগ রয়েছে।
দন্ডবিধি আইন অনুযায়ী ২৯৯ ও ৩০০ দন্ডবিধির ধারা থেকে কোনটি হত্যাকান্ড এবং ৩০২ দন্ডবিধির ধারায় শাস্তির বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কোন ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
দেওয়ানী কার্যবিধি
বাংলাদেশের আইন সভার নাম কি?
বাংলাদেশের আইন সভার নাম জাতীয় সংসদ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এটি একটি লিখিত দলিল।এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আইন।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বিভাগের নাম কি?
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বিভাগের নাম বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৪(ক) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার বর্ণনা করা হয়েছে।বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সুপ্রীম কোর্ট দুটি বিভাগ নিয়ে গঠিত। হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপীল বিভাগ। সুপ্রীম কোর্টের এই দুটি বিভাগের আলাদা আলাদা এখতিয়ার রয়েছে।
আপীল বিভাগ
হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের আপীল শুনে থাকে আপীল বিভাগ। এছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগের সত্যতা নির্ধারণের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি জেলা আদালত থেকে হাইকোর্ট বিভাগে আপীলে উত্থাপিত জনস্বার্থের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আছে আপীল বিভাগের।
হাইকোর্ট বিভাগ
সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ দেওয়ানী আদালত, ফৌজদারি আদালত এবং কিছু বিশেষ আদালত নিয়ে গঠিত।
বাংলাদেশ আইনের ইতিহাস
বাংলাদেশের বর্তমান আইন ও বিচার ব্যবস্থা অর্থাৎ আইনগত পদ্ধতি বিকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের উপর তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ব্রিটিশ নিয়মে।এছাড়াও কিছু কিছু বিষয় প্রাক-ব্রিটিশ আমলের হিন্দু এবং মুসলমান শাসন ব্যবস্থার অবশিষ্ট অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।
সহজ ভাষায় বলা যায়, বাংলাদেশের আইনের প্রক্রিয়াটি আংশিক স্বদেশী ও আংশিক বিদেশী এবং গঠন প্রণালী, আইনগত ধারণা ও নীতিমালার ক্ষেত্রে ইন্দো-মোঘল এবং ব্রিটিশ উভয় ব্যবস্থা সমন্বয়ে উদ্ভূত একটি মিশ্র আইনি ব্যবস্থা। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ আমলের পূর্ববর্তী পাঁচশত বছরেরও বেশি মুসলিম ও হিন্দু শাসনের প্রত্যেকটি শাসন আমলের নিজস্ব স্বতন্ত্র কিছু আইন ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।
বাংলাদেশে ফৌজদারী অপরাধ সংক্রান্তীয় দণ্ড দান করার জন্য প্রধান আইন ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর, ব্রিটিশ রাজ সমগ্র ভারতবর্ষকে সরাসরি আওতায় নিয়ে আসে এবং বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করে। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইন তাদের মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশের অদনাক্ত অধনস্ত বিচার বিভাগ, দেওয়ানী ও ফৌজদারী ব্যবস্থা এর উৎপত্তি দেওয়ানী আদালত আইন ১৮৮৭ এবং ফৌজদারী কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ থেকে হয়েছিল। এছাড়াও বাংলাদেশের আরো কিছু অন্যান্য বিশেষ আইন রয়েছে, যা কিছু বিশেষ আদালতের ভিত্তি স্বরূপ কাজ করে। এই আইনের মধ্যে শ্রম আদালত, শিশু অপরাধ আদালত এবং প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আজকে আর্টিকেলের আলোচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আইনের ধারা কতটি ও বাংলাদেশের আইনের ধারার শ্রেণীবিন্যাস সংক্রান্ত বিষয় এবং বাংলাদেশের আইনের ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি সংক্রান্ত বিষয় জানতে পারলাম। আশা করি এগুলো আমাদের জীবনের কোন না কোন সময় কাজে আসবে।
0 Comments