এক কথায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বিচারকদের নিরপেক্ষতা কে বুঝায়। বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যমে জনগণকে শাসন বিভাগের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা করা যায়। বিচারকগণ যদি স্বাধীন থাকতে না পারেন, তাহলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। এমনকি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্রের সুষ্ঠু প্রয়োগ কল্পনাও করা যায় না। বিচার বিভাগ পরাধীন হলে ন্যায় বিচার পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
আজকে আর্টিকেলটি সাজিয়েছি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা করা যায়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেন প্রয়োজন? প্রভৃতি বিষয়ের উপরে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ
জনগণের স্বাধীনতা বিচার বিভাগের উপর নির্ভরশীল। তাই বিচারকগণকে কোন বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিচক্ষণতা, সততা ও নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করতে হবে। বিচার বিভাগকে সর্বদা শাসন বিভাগ,সামাজিক ও অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত থাকতে হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
সাধারণত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বুঝায় অন্য কোন বিভাগের প্রভাব মুক্ত দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান মোতাবেক তাদের কার্যাবলী সম্পাদন করবে। অর্থাৎ বিচারবিভাগ যদি অন্য কোন বিভাগের প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে তাহলে তাকে স্বাধীন বিচার বিভাগ বলা যায়।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রামাণ্য সংজ্ঞা
[ kant, Independence of the Judiciary means independence and impartiality of the Judiciary.]
জেমস (James) -এর মতে, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা অর্থ বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও আপসহীনতা।
[James, Independence of judiciary means impartiality and impartiality of judiciary.]
অধ্যাপক লাস্কি -র মতে, স্বাধীনতার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সেই অর্থে ক্ষমতা পৃথকীকরণের মতবাদ স্থায়ী সত্যকে নিহিত করে।
[ Prof Laski, The Independence of the judiciary is essential to freedom. In that sense the doctrine of separation of powers enshrines permanent truth.]
Prof Garner, Independence of judiciary refers the fundamental rights and the constitutions as natural.
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা করা যায়
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় নিম্নে আলোচনা করা হলো—
১. শাসন বিভাগের স্বৈরাচারীতা রোধ : কোন রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ যদি স্বাধীনভাবে কাজ করে, তাহলে অনেক সময় স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। আর শাসন বিভাগ যদি স্বৈরাচারী হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা অসম্ভব। তাই শাসন বিভাগের স্বৈরাচারীতা বন্ধ করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব।
২. নিরপেক্ষতা : কোন রাষ্ট্রের বিচারপতিদের কাজের সমালোচনার উপর বাধা নিষেধ আরোপ করা দরকার। বিচার বিভাগের বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে নির্ভীকভাবে দায়িত্ব পালন অসম্ভব।
৩. সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতি অবলম্বন : সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতি অবলম্বন করে উপযুক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া। অযোগ্য ব্যক্তি রাজনৈতিক কারণে বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হলে বিচারক কর্তৃক জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতি দ্বারা যথার্থ আইনজ্ঞ ,সৎ, সাহসী ব্যক্তিগণ বিচারপতিদের আসনে নিয়োগ হলে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
৪. নিয়োগ পদ্ধতি : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতির উপর অনেক অংশ নির্ভরশীল। সাধারণত বিচারপতিদের ৩ পদ্ধতিতে নিয়োগ করা যায়। ক. জনকনের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচন, খ. আইনসভা কর্তৃক মনোনয়ন, গ. শাসন বিভাগ কর্তিক নিয়োগ। তবে বর্তমানে প্রধান নির্বাহী কর্তৃক বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে উপযুক্ত ও যোগ্যতম বিচারক নিয়োগের উত্তম পন্থা এটাই।
৫. বিচারকদের পদচ্যুতি : বিচারকদের পদচ্যুতি করার ক্ষমতা কোনো অবস্থাতেই শাসন বিভাগের উপর ন্যাস্ত করা উচিত নয়। কেবলমাত্র বিচার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তাদের মারাত্মক চারিত্রিক দোষ প্রমাণিত হলে বিচারকদের কার্যকাল এবং চাকরি থেকে বিচ্যুত করা যাবে।
৬. বেতন কাঠামো : বিচারকদের বেতন কাঠামো স্বল্প হওয়ায় তাদের দুর্নীতি পরায়ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শ্রেষ্ঠ যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক পদে আকৃষ্ট করার জন্য বিচারকদের বেতন-ভাতা পর্যাপ্ত হওয়া প্রয়োজন।
৭. অবসর গ্রহণের পর বিচারকদের ওকালতি বন্ধকরণ : বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের অধীনে তাদের ওকালতি নিষিদ্ধ করা উচিত। কেননা তারা অবসর গ্রহণের পর ওকালতি করলে বিচার বিভাগের রায় ও সিদ্ধান্ত কে প্রভাবিত করার জন্য পূর্ব পরিচয় ও প্রভাব কে প্রয়োগ করতে পারেন।
৮. বিচার বিভাগ কর্তৃক নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ : সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিচার বিভাগ নাগরিকদের উপযুক্ত অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করতে গিয়ে কয়েকটি বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে। যা নিম্নরূপ-
ক. হেবিয়াস কর্পাস, খ.ম্যানডেমাস ,
গ. সার্সিওয়ারি , ঘ. কোয়ারেন্টো।
বিশেষ এ পদ্ধতিতে রিট আবেদন জারি করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের রয়েছে। অধিকার বঞ্চিত যে কোন ব্যক্তির আবেদনক্রমে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃকক্ষকে বিচারের জন্য আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতে পারে।
৯. বিচারকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা : সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিবাহ হলো বিচার বিভাগ, যা জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে সে উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার রিট জারি করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেক সময় বিচারক গান সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। যা অনেকাংশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।
১০. লিখিত সংবিধান : অধ্যাপক গারনার বলেন, 'বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ব্যতি রেখে সভ্য রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। ' সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন যার মাধ্যমে দেশের শাসন কার্য পরিচালিত হয়। লিখিত সংবিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করে। বিচারকরা যদি লিখিত সংবিধানের ধারা অনুযায়ী রায় দেয় তাহলে জনগণের মধ্যে রায়ের সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি থাকবে না।
১১. বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ : শাসকের হাতে বিচারের ভার ন্যস্ত থাকলে ন্যায় বিচার পাওয়া যায় না। এরকম ক্ষেত্রে শাসন বিভাগ সহজেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ অপরিহার্য।
১২. পদোন্নতি : বিচারকের পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখা। যথাসময়ে পদোন্নতি না পেয়ে মানুষ হতাশা শিকার হয়। জেষ্ঠনীতির ভিত্তিতে পদোন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে বিশেষ কোন ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা ও মেধা ও পদোন্নতির ভিত্তি হতে পারে।
১৩. বিচারকদের স্থায়িত্ব : বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্ব বিশেষভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে সাহায্য করে। কার্যকালের স্থায়িত্বের অভাবে তাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি হয়। বিচারকদের কার্যকালের স্থায়িত্বের মেয়াদ অনিশ্চয়তা, অপসারণ পদ্ধতির নমনীয়তা বিচারপতিদের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং রাজনৈতিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার উপর নির্ভরশীল করে তোলে।
১৪. বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখা : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সাংবিধানিক বিধি-বিধান প্রয়োগ করে বিচার বিভাগকে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের প্রভাব মুক্ত রাখতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে, ফলে শাসন বিভাগের একচ্ছত্র আধিপত্য রোধ করতে হলে বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখা আবশ্যক।
১৫. কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা : আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা আদালতের হাতেই ন্যস্ত করা উচিত। এ ব্যবস্থায় আদালতের স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব।
বিচার বিভাগ বলতে কী বোঝায়?
আইন বিভাগ যে আইন প্রণয়ন করে, সেই আইন অনুযায়ী বিচার করাই হলো বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব। 'বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ব্যতি রেখে সভ্য রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। যারা বিচার করেন তাদেরকে বিচারপতি (সুপ্রিম কোর্টের বিচারক), জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট (প্রতি জেলায় ও মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত আদালত বা ট্রাইবুনালের বিচারক) বলা হয়।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেন প্রয়োজন?
বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যমে জনগণকে শাসন বিভাগের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা করা যায়। বিচারকগণ যদি স্বাধীন থাকতে না পারেন, তাহলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। এমনকি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্রের সুষ্ঠু প্রয়োগ কল্পনাও করা যায় না। বিচার বিভাগ পরাধীন হলে ন্যায় বিচার পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রয়োজন।
0 Comments